Wednesday, 12 December 2012

সিদ্ধান্ত

রমির আজকাল প্রায়ই মনে হয়, মানুষ এর যদি ঘুমের দরকার না পড়ত খুব ভালো হত ।প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটাতে ওর  সারাদিন লেগে যায়।
আজ ঘুম থেকে উঠে আয়নায় নিজেকে দেখল অনেকক্ষণ । মাঝে মাঝে ও কিছু ভাবতে পারেনা, কিছু বুঝতে পারেনা শুধু তাকিয়ে থাকে নিজের দিকে । কিছুক্ষণ পর বেডসাইড টেবিল এ রাখা দুজনের ছবিটা হাতে তুলে নিল । দেখল অনেকক্ষণ । ওদের দুজনের প্রথম ঘুরতে যাওয়া বিয়ের পরে । সেন্টমার্টিন এ । ছবিটা কে ও সরাতে পারেনি চোখের সামনে থেকে । কোনদিন পারবে বলে মনে হচ্ছেনা এই মুহুর্তে ।
আজ প্রায় সাত মাস হতে চলল অনুপম সাথে নেই । ২৫ নভেম্বর রাতে ওর  সাথে শেষ কথা হয়েছে ।  অনুপম জানিয়ে দিয়েছে ওর  চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত । অনুপম নতুন করে সব শুরু করতে চায় । নতুন সংসার করতে চায় । তাই রমিকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে চূড়ান্ত করে ফেলেছে । 

গতকাল অনেক রাতে বাসায় ফিরেছে রমি । অপেরা হাউস এর পাশে অনেক রাত পর্যন্ত বসে ছিল । একা । এর আগে আরো অনেক বার এসেছে । কিন্তু একা এই প্রথম । চুপচাপ বসে একটানা জলের শব্দ শুনতে শুনতে ও নিজের ভবিষ্যত টা  কে ভাবার চেষ্টা করছিল । বিভিন্নভাবে ।  অনুপমকে ছাড়া তার জীবন টা কেমন হতে পারে । রুদ্রের একটা কবিতা মনে পড়ল ওর ..
                                              "আকাশ থেকে ছিটকে পড়া
                                               তারার মতো কখন জানি
                                               অসংলগ্ন একলা আমি ছিটকে এসে
                                               আটকে গেছি নীল শহরে...
"


ও আসলেই আটকে গেছে এই নীল শহরে । দেশে ফিরে যাবার আর কোনো রাস্তা নেই । সবাই ওকে বলেছে দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে একটা একলা মেয়ের জীবনযাপন অনেক কষ্টের । সেটা নাকি এই লৌহপুরির একাকিত্বের কষ্টের থেকেও অনেক অনেক বেশি । রমি মনে মনে ভাবে হবে হয়ত । এতদিন নিজেই ওর  জীবনের সব বড় বড় সিদ্ধান্ত গুলো নিয়েছে । অনুপমকে বিয়ে করা, চাকরি ছেড়ে ওর সাথে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি  দেওয়া । কিন্তু এখন ও ভয় পায় আবার নিজের সিদ্ধান্তে কিছু করতে । আট বছর পরে এসে ওর  সব সিদ্ধান্তই যে আজ ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে ।

আশেপাশে ওয়াইন এর গন্ধ রমিকে অনুপমের পছন্দের পারফিউম এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল  । গ্লাসের শব্দ, ওয়েটার এর ছোটাছুটি, হাসির কলরোল, লাইভ মিউজিক, সবকিছুর মধ্যেও এক কোনায় ও একা বসে রইলো চুপচাপ। একজন ওয়েটার ওর  কাছে এসেও ফিরে গেল কিছু না বলে ।

ওর মনে হলো অনুপম কি আসে এখানে ? এইভাবে কি বসে থাকে একা ? নাকি আসে বন্ধুদের সাথে, এসে  মিশে যায় এই আনন্দ আয়োজনে ।
সিডনী তে এখন গ্রীষ্মকাল । রাতে যদিও বাতাসটা ঠান্ডা হয়ে যায় । তবু রমি আজকে শাড়ি  পরেছে। জলে ভেজা ঠান্ডা বাতাসটা শরীরটাকে ছুয়ে যাচ্ছিল । ও চুপচাপ শুধু তাকিয়ে ছিল  ঢেউ এর দিকে । মাঝে মাঝে ওয়াটার ট্যাক্সি এসে জেটিতে ভিড়ছিল আর ঢেউ বাড়িয়ে দিচ্ছিল  ।

হারবার ব্রিজের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এইত সেদিন নিউ ইয়ার এর দিনে ওরা দুপুর থেকে অপেক্ষা করছিল ফায়ারওয়ার্কস দেখার জন্য । প্রচন্ড  রোদের  কারণে ওরা ছাতি দিয়ে তাবু তৈরী করেছিল ।

রমি অবাক হয় মাঝে মাঝে । এত কিছুর পর ও  কেন অনুপম কে ভুলতে পারেনা ?  অনেকে বলেছিল এই  আবেগ নির্ভরশীলতা । কিন্তু চাকরি পেল তারপর ও কেন মনে পড়ে ? এটা কোন ধরনের নির্ভরশীলতা ? মানসিক ? অনুপম যাবার সময় বলেছিল মানসিক নির্ভরশীলতা ওর অপছন্দ নয় । ওর  অপছন্দ অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ।
এই ভাবনাগুলো ওকে শান্তিতে থাকতে দেয়না । মাঝে মাঝে মনে হয় এমন কিছু কি হয়েছে যা অনুপম ওকে বলতে পারেনি । তাই সরে গেছে নিজে থেকে ।

ছবিটা কে এতক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছিল রমি । খুব যত্ন করে আবার রেখে দিল বেডসাইড টেবিল এ । ও সিদ্ধান্তে পৌঁছলো অনুপম এর জন্য ওর এই অনুভূতির এক বর্ণ ও মিথ্যে নয় । এর সঙ্গে নির্ভরশীলতার কোনো সম্পর্ক নেই । ও ঠিক করলো  দুজনের আরো কিছু ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রাখবে ওর ঘরে ।

খলিল গিবরান এর একটি উক্তি মনে পড়ল ওর ..." “Ever has it been that love knows not its own depth until the hour of separation.”

No comments:

Post a Comment