Monday 9 December 2013

মেয়ে -১

শোনো আমার অমল মেয়ে
জীবনের উৎসবের রঙ মাখ গায়ে,
পাখায়, ঠোঁটে, চিবুকে
রঙিন প্রজাপতি হও, উড়ে বেড়াও

আর মনে মনে মাকে ছুঁয়ে যাও 

আমার ভালবাসারা

আমার ভালবাসারা এখনও নির্ঘুম রাত্রি কাটায়
কুয়াশার সাথে ঝিরঝির শব্দে ঝরে যায় অবিরাম
একলা দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে টুপটাপ
আমার ভালবাসারা এখনও তোমাকে খোঁজে
জুঁই এর গন্ধের সাথে, হেমন্তের হিমে ভেজা ঘাসের সাথে
খরবর্ষণে ভিজে যাওয়া ডাহুক এর সুতীক্ষ্ণ চিৎকার এর সাথে মিলেমিশে  
শিরশিরে অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে
পেলিকান এর শুভ্র ডানায় ভর করে, আমার ভালবাসারা
পাড়ি দেয় শত সহস্র মাইল;
পতপত শব্দে উড়ে যায়--- তোমার ঠিকানার দিকে

তুমি খুলে রেখ তোমার অলীক চেতনার জানালা 
দীর্ঘ যাত্রা শেষেও অক্লান্ত, আমার ভালবাসারা   
তোমার ঘোলা হয়ে যাওয়া চশমার কাঁচ বেয়ে
বৃষ্টির ফোঁটার মত নেমে আসবে
তারপর, তোমার চিবুক ছুঁয়ে
শস্যদানার মত ছড়িয়ে পড়বে তোমার সমস্ত শরীর জুড়ে
সেলিস্ট এর উন্মাদনা নিয়ে সুর তুলবে
তোমার নির্ঘুম রাত্রির ক্লান্তি কাটিয়ে, তোমাকে এক অলৌকিক ঘুমের দেশে পাঠিয়ে

তবেই বিশ্রাম নেবে আমার ভালবাসারা ...

দুরত্ব

তেমন কিছুইতো নয়
চেনা রেস্তোরাঁ, একটা ছোট টেবিল আর মুখোমুখি দুজন
চারিপাশে কথার কোলাহল,  অথচ কিছুই প্রবেশ করেনা করোটিতে   
মাঝে মাঝে ওই দুরত্বটুকু কি মধুরভাবে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে
নির্মম উপহাস যেন
চাইলেই ছুঁয়ে দেওয়া যায় আবার যায়না
চায়ের কাপটা হাতে দিয়ে বলা যায় ‘এই নাও তোমার চা’
অথচ কাপটা এগিয়ে দিতে হাত ওঠেনা
পরিপাটি চুলগুলো দুরন্ত আঙ্গুল এর ছোঁয়ায় এলোমেলো করে দেওয়া যায় নিমেষে
চোখ থেকে খুলে নেওয়া যায় চশমা
বলা যায় ‘অনেক হয়েছে এবার চোখ বন্ধ’
অথচ কিছুই করা হয়ে ওঠেনা
পৃথিবীর সমস্ত অভিমান তখন বাসা বাঁধে পাঁজরে
কুরে কুরে খায় হৃদয়ের স্পন্দন
চেনা রেস্তোরাঁর
ওই এক টেবিল দুরত্বের মাঝে খেলে যায় নিশ্ছিদ্র নীল নীরবতা
শুধু আড়চোখে দেখে নেওয়া কতটুকু বদলেছে সে  
চোখ অচেনা, চুল অচেনা
আর চিরচেনা হাসিটুকু, তাও যেন অচেনা   
আজকাল নিজেই চিনিনা আর নিজের প্রতিবিম্ব 

সেতো বহুদুরের মানুষ, বহুদুরের মানুষ ...

শূন্যতা -১

আমার ভেতর বাড়ীর একমহলা উঠোন জুড়ে
এখন কেবলই শূন্যতার রাসউৎসব
নিকনো প্রাঙ্গনে রঙবাহারি অভিমানের পসরা নিয়ে
বসে আছি একলা বাউল 
ক্রেতা নেই তার
হাহাকারের মাদল ধ্বনিতে হৃদয়ের তাণ্ডব নৃত্য চলে সেখানে
রাতভর, কোজাগরী চাঁদ ভাসে চোখের বেনোজলে

সে জলে পুণ্যতার স্নান সারে প্রাচীন হৃদয়  

আক্রোশ

মাঝে মাঝে মনে হয়
দুম করে পাল্টে দিই পৃথিবীর খোলনলচে
অনেকটা শেষ বলে ছক্কা পেটানোর মত
শার্সির এর কাঁচ এর মত ঝনঝন শব্দে ভেঙে যাই
সেই কাঁচে পা রেখে রক্তাক্ত হোক, শুধু রক্তাক্ত হোক কবিতাহীন হৃদয় 
টেনে ছিঁড়ে ফেলি শৈল্পিক মুখোশ,
ঠোঁট থেকে উপড়ে নিই মনোরম মেকি হাসি
শরীরে বুনে দিই ফণীমনসার বীজ
দুঃস্বপ্নময় করে দিই তার রাত্রিদিন
লুকিয়ে রাখি তার চোখের ঘুম প্রাণভোমরার মত
আমারই গহীনে
সে বুঝুক, নির্ঘুমতার যন্ত্রণা কি ভীষণ!!
ফ্রিজশটে স্তব্ধ করে দিই তার চলে যাওয়া

আমার দিকে ফিরে হেসে, তার শেষ চলে যাওয়া । 

জেগে ওঠো অমল মেয়ে

ক্ষোভের আগুনে আর কত পুড়বে তুমি মেয়ে ? 
নিজেকে নিজে আর কত ধ্বংস করবে তুমি ?
অতটা পুড়োনা আর
তোমার জীবনটা তো শুধু তোমারই 
বাঁচ, ভীষনভাবে বাঁচ
'না' বলো সমস্ত প্রতিকূলতাকে
'না' বলো সমস্ত ভয়কে 
'না' বলো মনের দাসত্ব কে 
'না' বলো সমস্ত ধ্বংস কে
সৃষ্টি করো, শুধু সৃষ্টি করো নিজের জীবন 
ভরিয়ে তোলো আনন্দে
ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দাও সমস্ত অকল্যাণ
বিদ্রোহ করো, ছিনিয়ে নাও তোমার স্বাধীনতা
বাঁচ মেয়ে, বাঁচতে শেখ
জেগে ওঠো আমার মেয়েটা
সকালের স্নিগ্ধ অরুণ হয়ে, অমল আলো হয়ে
যে আলো তোমার ঘুমন্ত গালে পড়ে স্বর্গীয় আভা তৈরী করে
জেগে ওঠো, দেখো
এ পৃথিবী তোমার হাসিমাখা অধরে লুটিয়ে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে........

Friday 1 November 2013

তানিয়া

আজ হঠাৎ তানিয়ার কথা মনে পড়ল
তানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাসমেট ছিল
ক্লাসমেট ? হ্যাঁ ক্লাসমেট ই
বন্ধু ছিল কিনা ঠিক জানিনা
যাই হোক, তানিয়া বেশ সুন্দরী স্মার্ট একটা মেয়ে
স্বাধীনচেতা, স্পষ্টভাষী, নিজের কাজ নিজে করতে পারদর্শী
তাই বলে ভাববেননা যে সে অভাব অনটনে বড় হয়েছে
আমরা আজকাল স্বাধীনচেতা মেয়ে দেখলেই ঠাউরে বসি
জীবনের ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করাতেই বোধহয় তার জীবনবোধ এত চড়া
কিন্তু সে যথেষ্ট ধনীর ঘরের মেয়ে ছিল  
দুনিয়া কাঁপিয়ে হাসত  
একদিন খবর পেলাম আমার সেই ক্লাসমেট, মানে তানিয়া
আত্মহত্যা করেছে
কেন ? ঠিক জানা গেলনা
আর আমার তখন এত জানবার সময় কোথায়
আমি তখন মধ্যবিত্ত বাবার দেওয়া জীবনবোধের পাঠকে দুপায়ে ঠেলে
এই মহিমান্বিত জীবন কে আরও মহিমান্বিত করবার আশায় পাখির ডানায় উড়াল দিতে ব্যাস্ত
একজন এসকেপিষ্ট ক্লাসমেট এর জন্য সহানুভুতি জানাবার প্রয়োজন ই বা কোথায়
কিই বা এমন হয়েছিল ? মায়ের বকুনি ?
তাতেই এত অভিমান ?
ধনীর দুলালীই বটে
এসকেপিষ্ট ! মনে মনে বেশ একচোট নিলাম
সত্যিই কি তাই ? তানিয়া সুন্দরী, স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবক্তা -- তা বলে কি তার মনে কোন দুঃখ থাকতে পারেনা ?
পারবেনা কেন ? দুঃখ কার নেই ? তা বলে জীবন ছেড়ে পালানো ?
তাও ঠিক … তা বলে পালাতে হবে এই মহিমান্বিত জীবন ছেড়ে !
না ওর জন্য কোন সহানুভূতি নেই, সুভাষণ নেই, কারণ খোঁজবার দরকার নেই
সমস্ত সুভাষণ শুধু তাদের জন্য
যারা বেঁচে থেকেও প্রতিনিয়ত নিজের কাছ থেকে নিজে পালিয়ে বেড়ায় 
সমস্ত মনস্তাত্বিক ব্যাখা শুধু সেইসব সফল মানুষদের জন্য
যারা নিজের পাপবোধ থেকে বাঁচতে,
নিজের ভেতরে কেঁচোর মত কিলবিল করে ওঠা কাপুরুষতা থেকে বাঁচতে মুখোশের আশ্রয় নেয়
সমস্ত প্রশংসাবাণী শুধু তাদের জন্য
যারা তাদের সফলতার আড়ালে ঢেকে রাখে তাদের সমস্ত স্বার্থপরতা
আর তানিয়াকে বলে স্বার্থপর
তানিয়াকে বলে এসকেপিষ্ট



Wednesday 30 October 2013

গন্তব্য

মধ্যরাত্রি
আনন্দ হাসিতামাশা পানাহার শেষে বন্ধুরা ফিরে গেছে যে যার ডেরায়
স্টেশনে শেষ ট্রেনের অপেক্ষায় আমি
ট্রেন আসবে, ঠিক সময়মত ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে
আমাকে নিয়ে যাবে, নামিয়েও দেবে ঠিক তিনটে ষ্টেশন পরে
কিন্তু আমি গন্তব্যে পৌঁছবনা কারণ আমার কোন গন্তব্য নেই
আমি ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চেনা রাস্তা ধরে রোবটের মত যেতে থাকব
পথ চিনতে আমার কোন ভুল হবেনা
আমি হাঁটব অঙ্ক কষে কষে
বাম থেকে ডানে, তারপর কিছুটা সোজা হেঁটে আবার বামে
পথে হয়ত দেখা হয়ে যাবে আমারই মত গন্তব্যহীন কোন এক পাঁড় মাতাল এর সাথে
তার খিস্তি খেউড় কে অগ্রাহ্য করে আমি হাঁটতে থাকব, এমনভাবে
যেন কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় আছে
যেন ঘরে ফিরলেই কেউ আমাকে আগলে নেবে তার দুবাহুতে  
আমার বাম চোখের কোণে-- ভুরুর ঠিক উপরে, ঠিক ওইখানে যেখানে মায়েরা নজরফোঁটা দিয়ে রাখে--
একটা অভিমানভরা আলতো চুম্বন দিয়ে বলবে “এত দেরি ? আমি কখন থেকে বসে আছি”
আমি সেই তার কাছে নিজেকে সমর্পণের নেশায় আরও দ্রুতগতিতে হাঁটতে থাকব
তারপর বড় রাস্তা পেরিয়ে আমি একটা ফুলের গন্ধভরা গলিতে ঢুকে যাব  
মহুয়া, গন্ধরাজ আর হাস্নাহেনার গন্ধে আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকব
তারপর আবার হাঁটতে থাকব এবড়োখেবড়ো গলিটা ধরে
এরই মধ্যে ব্যাগ থেকে বের করে নেব ঘরের চাবি
আমি প্রায় পৌঁছে গেছি
আমি দরজা খুলব সন্তর্পণে, যেন প্রতিবেশীরা না জাগে
আমি একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকব
হাতের পাশেই আলো জ্বালবার সুইচ থাকবে কিন্তু আমি আলো জ্বালবোনা
শুন্য ঘরের নির্মম বাস্তবতাকে দুচোখ দিয়ে দেখব
কিন্তু আমার চোখ দিয়ে একফোঁটাও অশ্রু ঝরবেনা
এমনকি আমি কোন দীর্ঘশ্বাস ও ফেলবোনা
এভাবেই প্রতিদিন আমি ঘরে ফিরব কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছবনা

কারণ আমার কোন গন্তব্য নেই ...

Friday 11 October 2013

আশীর্বাদ

তুমি বললে “আমার সমস্ত আশীর্বাদ, সমস্ত মঙ্গলআকাঙ্ক্ষা তোমাদের জন্য
তোমরা এগিয়ে যাও”
নিজের আজন্ম লালিত সপ্নকে ডুবিয়ে দেবার কষ্টকে বুকে চেপে  
তোমার কান্নাভেজা কণ্ঠ পিছনে ফেলে,
ভালবাসার হাত ধরে ছুটে চলে গেলাম
ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁর মায়াবি আলোর আয়োজনে  
জুলাই শেষের সিঙ্গাপুর, ভ্যাপসা বাতাস, চারিদিকে নয়নাভিরাম কাঠমল্লিকার ঝোপ
কিন্তু এতটুকু সুবাস ছিলনা বাবা, জানো ?
তোমার আশীর্বাদ কি ভুল ছিল বাবা ? নাকি আমি ওগুলোকে ভুলে ফেলে এসেছিলাম ?
সেংকাং এর সেই গগনচুম্বী অট্টালিকার সুইমিং পুলের ধারে
মনে পড়েনা আর …
শুধু এটুকু জানি, ওরা আমার সাথে আসেনি বাবা এই রুক্ষ লাল মাটির দেশে 

মার্চের গনগনে বাংলাদেশ, কৃষ্ণচূড়া আর পলাশের আগুন চারিদিকে
ছায়া ভরা টিনের বাড়ীটা ম ম করছে সজনে ফুল, আমের মুকুল আর লেবু ফুলের গন্ধে
সকাল থেকে আত্মীয়রা একে একে এসেছেন শেষবার দেখা করতে
কোণার ঘরে দুপুরের নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে আছেন নানু
দুজনকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন “আল্লাহ তোমাদের সকল ইচ্ছা পূর্ণ করুন
ফুটফুটে একটা সন্তান হোক তোমাদের, আমার দোয়া রইল”  
বিদায় নেবার সময় হয়ে এল
তখন রাত, নিয়মমাফিক লোডশেডিং এর অন্ধকার চারিদিকে
বিশাল মহুয়া গাছটার ফাঁকে, মস্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে
আজ পূর্ণিমা নাকি ? চাঁদটাকে আরেকবার দেখে নিয়ে
থলিভর্তি আপনার দোয়া নিয়ে আমি ফিরে এলাম নানু
চার হাজার মাইল বিমানভ্রমণের কথা মনে হতেই আমার ক্লান্তি এল
আমি ভালবাসার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলাম
এর ফাঁকে কখন যেন আপনার সব দোয়া থলি থেকে পড়ে, বিমানের জানালা গলিয়ে
বৃষ্টি হয়ে ঝরে ঝরে গেছে বাংলাদেশের আকাশে
নানু, আমি জানতেও পাইনি

এখন অক্টোবর, সিডনীর বাতাসে  শুধুই জুঁই ফুলের গন্ধ  
এখানে যদিও শিউলি ফোটেনা, তবুও সাড়ম্বরে মা দুর্গা আসেন তার সন্তান সন্ততি নিয়ে
লাল টালির বাড়ীটার নীচতলা এই প্রচণ্ড গরমেও বেশ ঠাণ্ডা
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে বলি … ‘দিদি আমি যাই’
দোতলা থেকে ভেসে এল “আচ্ছা এস … দুর্গা দুর্গা”
নীচতলার ঘরে প্রতিধ্বনি হল “দুর্গা দুর্গা”
কিন্তু আমি জানি দিদি
ঢালাই লোহার সাদা গেট পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে না উঠতেই  
তোমার দুর্গা আমাকে ছেড়ে যাবেন
যেমনটা গ্যাছে আমার বাবার আশীর্বাদ, আমার নানুর দোয়া
তবে এবার আমি ঘুমে অচেতন থাকবনা
এবার আমি, হাসিমুখে তার চলে যাওয়া দেখব …




রুমি'র কবিতা থেকে অনুবাদ

ভঙ্গ হোক তোমার নিরন্তর মৌনতা
কেঁপে কেঁপে উঠুক তোমার হৃদয়
জেগে উঠুক তোমার ভালবাসা
তারি জন্য আমার অনন্ত প্রতীক্ষা...

অনুকাব্য

আজ এখানে বসন্ত, ঠিক এইখানে ... আমার মনের ভেতর
মুঠো ভরে তুলে এনেছি বেল ফুল আর তার ছায়া ছায়া মায়া

কিন্তু তুমি পাওনি তার খোঁজ ...

অনুকাব্য

আমার কষ্টগুলো এখন বেশ পরিণত
রাত দুপুরে যখন তখন আর ঝরঝর করে ঝরে পড়েনা
ওরা এখন পরিপক্ক নিপুণ হাতে বুকের গভীরে গর্ত খোঁড়ে
গাঁইতি চালায় দিনরাত ...নিঃশব্দে--

কুরে কুরে খায় হৃদয়ের স্পন্দন .. 

একজন চা প্রেমিকের জন্য


মেয়েটি কখনো চা ভালবাসেনি
চিনির সঙ্গে চা-পাতা পুড়িয়ে তার রঙ দিয়ে
কখনো আঁকেনি আলপনা হাতে
কিন্তু সে ভালবেসেছিল তার প্রেমিক কে
ভালবেসেছিল চা বাগানের পাহাড়-জঙ্গল, নুড়ি বিছানো নদী পথ  
আর তার প্রেমিক ভালবেসেছিল সমুদ্র, উত্তাল উন্মাতাল সমুদ্র
কী ভীষণ বৈপরীত্য !
যদিও চা ভালবাসেনি মেয়েটি কিন্তু নতুন সংসারে সে কিনে আনল দুটি চায়ের কাপ  
জুঁই সাদা, দোকানে দোকানে খুঁজে ফিরলো আসাম, সিকিম, দার্জিলিং চা 
সমস্ত শহর তন্নতন্ন করে খুঁজল একটি সমুদ্র সবুজ টি-পট,  
আর জংলা ছোপের টি-কোজি... মনে মনে পাখা মেলে কল্পনা
সমুদ্র সবুজ টি-পট, ঢেকে যাবে জংলা ছোপের টি-কোজি তে  
আর তার ভিতরে ধীরে ধীরে রঙ ছড়াবে
আসামের বিসাকপি কিংবা বিজু এস্টেট এর কড়া ঘ্রাণ এর চা, মেয়েটি ভাবে
নিশ্চয় কোন এক নুড়ি বিছানো নদীর জল বর্ষার ঢল হয়ে ছুঁয়ে গেছে এ চায়ের পাতা
ভেবে ভেবে নিজের অজান্তেই হেসে ওঠে মেয়েটি  
মেয়েটি চা ভালবাসেনি, ভালবেসেছিল নুড়ি বিছানো নদী পথ 
ভালবেসেছিল তার সমুদ্রসম প্রেমিককে
তাই সে খুঁজেছিল
ছোট্ট একটি টি-পট, যাতে শুধু মাত্র দুজনের- একান্ত দুজনের চা ধরে
মেয়েটি চা ভালবাসেনি বটে, কিন্তু তার প্রেমিক তো বেসেছিল   
তবুও তার কখনো কেনা হয়ে ওঠেনি ছোট্ট টি-পট, জংলা ছোপ টি-কোজি
তার আগেই উত্তাল সমুদ্র ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার প্রেমিককে, তার সংসার
রয়ে গেছে শুধু ডিএসএলআর এর ক্লিকে ফ্রেমে বন্দী হওয়া  
জুঁই সাদা চায়ের কাপ, হাসিমুখ আর তার বিপরীতে
পড়ন্ত সোনালী বিকেল আর জুঁই এর গন্ধভরা হু হু করা চৈত্রের বাতাস


Tuesday 8 October 2013

ছায়ার সঙ্গে কথোপকথন

এতটা আত্মবিস্মৃত এখনও হইনি আমি
হইনি বিচ্ছিন্ন বিমগ্ন নিজের সত্ত্বা থেকে
আমার শিরা উপশিরা এখনও প্লাবিত হয়নি আত্মপ্রতারণার নীল বিষে  
যে আমাকে তুমি পরিচয় করিয়ে দেবে আমার অস্তিত্বের কণ্ঠস্বর এর সঙ্গে
ক্ষীণ দ্বিধান্বিত কণ্ঠে যখন বলে ওঠো “...শুনছো ? আমি ...আমি বলছি”
টিয়া পাখির এক একটি ঘন সবুজ পালক উড়ে উড়ে এসে জমা হয় বুকের বন্ধ তোরঙ্গে
তোরঙ্গের প্রতিটি খাঁজের খাজাঞ্চিখাতায় থেকে যায় পেজমার্ক হয়ে
আমি একটুকুও অবাক নই, উচ্ছসিত নই, হতবিহ্বল নই
কেননা আমি চিনি তোমার কণ্ঠস্বর, আমার অস্তিত্বের কণ্ঠস্বর
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত – হোক তা দুর্গম, গহীন কিংবা সমতল ব-দ্বীপ এর কোন ছায়াসুনিবিড় গ্রাম –
থেকেই তা ভেসে আসুকনা কেন, আমি চিনি
কারণ আমি চিনি আমার অস্তিত্বকে
আমি চিনি আমার নিজের ছায়া
আমার ‘আমি’ কে আমি চিনি
শুধু তুমিই চেননি আমাকে  ...


চলেই যদি যাবে তবে কেন এসেছিলে

চলেই যদি যাও
কেন রয়ে যাও বুকের ভেতর এত গভীর করে ?
একটুখানি হোঁচট খাওয়া ব্যাথার মত
বাক্সবন্দী চিঠির হলদে হয়ে যাওয়া পাতার মত
দেয়ালের গায়ে লেগে থাকা শেষ বিকেলের বিষণ্ণ একটুকরো রোদ্দুরের মত
যত্নে বোনা মেখলার ভাঁজে ভাঁজে রাখা দারুচিনি আর এলাচ এর সুবাস এর মত
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কেউ যেন ডাকল ভেবে পেছন ফিরে তাকানোর মত
কেন রয়ে যাও ?
চলেই যদি যাও,
মুঠোফোনের ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা “...আমি” ধ্বনি হয়ে
কেন ফিরে ফিরে আস কুয়াশাঘেরা স্মৃতির কানাগলিতে ?
ফেলে রেখে খেলাধুলার সরল সংসার, চলেই যদি গেলে  
শুন্য কেন করে দিয়ে গেলেনা স্মৃতির ভাঁড়ার ?  
আনাড়ি হাতে গীটার এর তারে তোলা টুংটাং শব্দের মত
হৃদয়ের ছিলায় তুলে টান, চলেই যদি যাবে

তবে কেন এসেছিলে ? 

Saturday 5 October 2013

শূন্যতায় কার ছায়া

কুয়াশাভেজা চাঁদের ম্লান আলোয় ভেসে যায় নিস্তব্ধ চরাচর
বুকের হাঁপর থেকে বেরিয়ে আসে গাঢ় দীর্ঘশ্বাস
নিদারুণ হাহাকার ফিরে ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে
খাঁ খাঁ করা শূন্যতায় কার ছায়া পড়ে ?
কে ওখানে ?
ঘামে ভেজা পিঠ, অবসন্ন পা
বিষাদগ্রস্ত মুখ
কে ? কে তুমি পেরিয়ে যাও বুকের সীমান্তের কাঁটাতার ?
কে নাড়িয়ে যাও বন্ধ দুয়ার ?
পথিক ! ক্লান্ত পথিক !
পেরিয়ে এলে বুঝি সুনীল সাগর ?
অথৈ প্লাবন ? ব্লাষ্টফার্নেস এর মত জ্বলে যাওয়া প্রান্তর ?
এলে বুঝি জয় করে সুউচ্চ পর্বতশিখর ?
অলিম্পাস এর পাদদেশ এ দেবী হেরার মন্দির এ---
নতজানু হয়ে প্রার্থনায় প্রার্থনায় বুঝি আমাকেই খুঁজছিলে তুমি ?
মেলেনা উত্তর –
শুধু প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে দীর্ঘশ্বাস
ফিরে আসে হাহাকার

ফিরে আসে শূন্যতা ...

মাচ্চু-পিচ্চুতে অস্তিত্বের ছায়া

ছায়া ছায়া শরীরে দীর্ঘক্ষণ হেঁটে চলেছি পাশাপাশি দুজন
সাদা সাদা মেঘের কাঁথায় ঢেকে গিয়েছে পাণ্ডুরবর্ণ চাঁদ ততক্ষণে
চারিদিকে তরল অন্ধকার  
নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না
হঠাৎ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি
এ কোন অচেনা তুমি !
ছুঁতে গেছি যেই
সরে গেলে দূরে
ক্রমাগত দূরে যেতে যেতে পৌঁছে গেলে মাচ্চু-পিচ্চুর উচ্চতায়
তোমার অস্তিত্বের ছায়া ক্রমাগত বড় হতে হতে
পাদদেশে দাঁড়ানো আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে
আমার বুকের ভেতর তখন দুড়মুশ পেটার শব্দ শুধু ---
ঘেমে নেয়ে একাকার আমি
চোখ খুলে দেখি সাদা মেঘের কাঁথা ছেড়ে জেগে উঠেছে পাণ্ডুরবর্ণ চাঁদ,
তার হলদেটে আলোয় প্লাবিত হচ্ছে বহু পুরনো একটি যুগল ফটোগ্রাফ; আর
একটা আস্ত মানুষ গিলে খাবার ক্ষুধা নিয়ে হা হা করছে
আমার একতলার পরিপাটী সাজানো ঘর
শুধু তুমি রয়ে গেলে মাচ্চু-পিচ্চুর উচ্চতায়

আমার ঘুমটুকু কেড়ে নিয়ে --- 

শুধু তোমার কথা ভেবে

তোমার কথা ভেবে ভেবে আমার রাত কাটলো
আমার সকাল হল তোমার কথা ভেবে   
হাঁসের ডিমের খোলসের মত নীলচে আকাশ জুড়ে সোনালী রঙ ধরল
তারপর সূর্য উঠি উঠি করেও আর উঠলোনা
নীলচে বেগুনী আকাশটা ধীরে ধীরে হয়ে গেল তোমার ছাই রঙা টি-শার্ট 
তোমার ওই ছাই রঙের বিস্তৃত আকাশে মুখ গুঁজে
কত কত রাত্রি-দিন কেটেছে আমার; কুম্ভকর্ণের মত ঘুমে
আজ সারাদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হল তোমার কথা ভেবে
আমার বেলা গেল, সন্ধ্যে হল
আজ আমার কোন কাজ হলনা শুধু তোমার কথা ভেবে  


Tuesday 17 September 2013

ভেজা এই শহরটা

ভিজছে বিদ্যুতের পোল, সাইনবোর্ড, ল্যাম্পপোস্ট
ভিজছে নিমগ্ন কারপার্কিং
ভিজে যাচ্ছে বারান্দায় ঝুলে থাকা নিঃসঙ্গ তোয়ালে
ভিজতে ভিজতে দর হেঁকে চলে নিলামি
পারলে ভেজা এই শহরটাকে বিকিয়ে দেয় জলের দরে
বর্ষাতি আর ছাতির আড়ালে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে যান্ত্রিক মানুষ
কেউ কেউ আড়চোখে একবার দেখে নেয় সবজি দোকানীর হাঁকাহাঁকি
ভিজে হাওয়ায় ভিজে ভিজে সুর ছড়াচ্ছে উইন্ডচাইমস
ভিজে যাচ্ছে এই শহর
ভিজে যাচ্ছে যান্ত্রিকতা
হায়েডিজ এর শোকের অশ্রুতে,
ধুয়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে, ভিজে ভিজে কুঁকড়ে যাচ্ছে এই একাকী বিষণ্ণ শহর ...

মস্তিষ্কের ঘেরাটোপে বাংলা মোটর


কাঠমল্লিকায় ছাওয়া বাঁধানো উঠোন
গতরাতের বৃষ্টিতে জলজমা কোণটা হরিণীর চঞ্চলতায় পেরিয়ে,এক লাফে লাল ইটের সিঁড়িতে পা
সমুদ্র সবুজ শাড়ীর আঁচলটা একটু ঠিক করে নিতে নিতে, হঠাৎ পিছু ফিরে অফিসঘরটা একটু দেখে নিয়েই একছুটে চিলেকোঠার ঘরের সামনে
কাঠের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ
কেউ আছেন ?
-ও আপনি !
অন্য কাউকে আশা করছিলেন ?
-না মানে ঠিক তা নয়  
তাহলে ?
-বসুন  
পড়ছিলেন ?
-এই আরকিআচ্ছা আপনি রেলের ফেরীর গল্প শুনেছেন?
রেলের ফেরী !!
রেল বুঝি ফেরী করে নদী পাড়ি দেয় !!
-কি ভীষণ বোকা আপনি  
-হাসছেন যে ?
আচ্ছা আর হাসবোনাবলুন আপনার রেলের ফেরীর গল্প 

-চা খাবেন ?
আপনি বানাবেন ?
-কেন ? পারিনা ভেবেছেন ?  
কই আপনার গল্প বলুন !

-একসময় গোয়ালন্দ ঘাট থেকে ছাড়ত  রেলের ফেরী গোয়ালন্দে এসে থামা রেলের যাত্রীরা, রেল থেকে নেমে ফেরী করে নদী পার হয়ে,ওপারে অপেক্ষা করতে থাকা রেলে চড়ে আবার রওনা দিত যে যার গন্তব্যে
-তারপর ?
তারপর ধরুন সেই রেলের কোন যাত্রীর হয়ত নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই
-তো আপনার সেই যাত্রীটি কি কোন নারী ?
সেটা বলবনা । ভেবে নিন আপনার যা ইচ্ছে হয় আচ্ছা আপনি ঘুরতে ভালবাসেন ? গন্তব্যহীন, উদ্দেশ্যহীন...
-প্রচণ্ড  
আমার সঙ্গে যাবেন ? পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রে ...

-আচ্ছা ধরুন সত্যি এমন যদি হত ! রেলের কামরায় মুখোমুখি বসা যাত্রীরা পড়ন্ত বিকেলের অদ্ভুত ম্লান আলোয় ফেরী করে পাড়ি  দিচ্ছে পদ্মা । কেমন হত ?
মন্দ না, সূর্যটা ঠিক লাল রুবির মত আলো ফেলবে রমণীর নরম গালে । আর তাকে দেখলে মনে হবে যেন দেবী ভেনাস সদ্য স্নান করে উঠে এসেছেন মর্ত্যে গোলাপের মতই প্রস্ফুটিত তার ওষ্ঠ । দীর্ঘ কেশরাজি থেকে বিন্দু বিন্দু গড়িয়ে পড়বে জল ।     
-তাহলে স্বীকার করলেন আপনার সেই যাত্রীটি একজন নারী
না আগে ভাবিনি । আপনি পড়ন্ত বিকেলের অদ্ভুত আলোর কথা বললেন তখন মনে পড়ল ভেনিস নগরীর কথা, দেবী ভেনাস এর কথা । আপনি সমুদ্র পাড়ি দেবেন আমার সাথে ?

ঘুলঘুলির নকশার ভিতর দিয়ে আলো এসে, অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলে চলে বিছানায় শেষ বিকেলের নরম আলো । কাঁঠালবাগানের ভিতরের দিকের লোহালক্কড়ের দোকান থেকে ভেসে আসে একটানা হাতুড়ি পেটার শব্দ । ঢাকার বৃষ্টিধোয়া বাতাসে কাঠমল্লিকার গন্ধ মিলেমিশে এক হয় সমুদ্র সবুজ শাড়ি, নীল টিপ এর সাথে ।

এদিকে চিলেকোঠার ঘরে কেরোসিন এর স্টোভ এ চায়ের পানি ইতোমধ্যেই শুকিয়ে গেছে ...